শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ॥
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। শুধু দেশি নয়, বিদেশী পর্যটকদের কাছে একটি দর্শনীয় স্থানের নাম। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক এই স্থানটিতে আসেন। কি রয়েছে এখানে! দীর্ঘতম সৈকত আর সমুদ্রের নীল জলরাশিই পর্যটক আকর্ষণ করে।
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে সব চেয়ে বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। এছাড়া সরকারী ছুটির দিনেও এখানে থাকে পর্যটকের আনাগোনা।
লংবীচ আর বিস্ময়কর ও রহস্যময় বড়ো বড়ো ঢেউয়ের খেলা নিজের চোখে একপলক দেখার জন্যই এখানে পর্যটকদের আগমন ঘটে। যা কক্সবাজারকে করে তুলেছে আকর্ষণয়ি এক পর্যটন কেন্দ্র।
কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, ডায়াবেটিকস হাসপাতাল পয়েন্ট, সীগাল হোটেল পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলি পয়েন্টসহ আরো বেশ কয়েকটি সৈকত পয়েন্টে লোনা জলে গা ভেজান পর্যটকরা।
সাগরতটের নোনা জলে গা ভাসাতে গিয়ে ¯্রােতের টানে অনেকে নিখোঁজ কিংবা মৃত্যুরকুলে পতিত হচ্ছেন। বৈরী আবহাওয়া এবং সমুদ্র সৈকতে জোয়ার-ভাটার হিসাব না মেনে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে গোসল করতে নেমে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গিয়ে মৃতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সর্বশেষ ১৬ জুলাই শনিবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্ট থেকে এক কিশোরী ও নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিন সকাল ১০টায় সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে ষোল বছর বয়সী এক কিশোরীর লাশ ভেসে আসে। এসময় সৈকত পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকা নারী কর্মীরা লাশ দেখে সি সেইফ লাইফ গার্ডকে খবর দেয়। পরে লাইফগার্ডকর্মী ও ট্যুরিস্ট পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
একই দিন বেলা ১টার দিকে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গোসলে নেমে নিখোঁজ হওয়া শিশু মোহাম্মদ শিহাদ (১২)। বেলা আড়াইটার দিকে সমুদ্র সৈকতের নাজিরারটেক পয়েন্টে ভেসে আসলে শিশুরটির মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। শিহাদ কক্সবাজার শহরের বৈদ্যঘোনা এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফিকের ছেলে। এর আগে পাঁচ দিনে ¯্রােতে ভেসে যাওয়ার সময় অন্তত ৪৫ জন বিপন্ন পর্যটককে জীবিত উদ্ধার করে ।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে লাবণী, শৈবাল, সী-ইন, কলাতলি ও ডায়বেটিকস হাসপাতাল পয়েন্টে গোসল করতে নেমে চোরাবালিতে আটকে পড়া, গুপ্ত খাদে পড়া ও ঢেউয়ে তোড়ে ভেসে যায় সাতাঁর না জানা পর্যটকরা। মেধাবী ছাত্রদের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটলেও এনিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই স্থানীয় প্রশাসনের ।
তবে ১৯৯২ সালের দিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৈকতে সীনেটিং স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, সমুদ্র সৈকতে বার বার প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। একই ভাবে প্রতি বছর সৈকত থেকেই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে। কিন্তু সী-নেটিং কিংবা পর্যটকদের জন্য কোন কার্যকরী ব্যবস্থা এ পর্যন্ত নেয়া হয়নি।
সী-বীচ ম্যানেজম্যান কমিটি সৈকতে লাইফ গার্ড নিযোজিত না করলেও সাগরে ডুবে নিহত ডানকান গ্রুপের চেয়ারম্যান এর ছেলে ইয়াছির এর স্মরণে স্থাপন করা করা লাইফগার্ড স্টেশন। পরবর্তীতে থেকে বেসরকারী উদ্ধার কর্মী দল ওয়াচবে সিসিলন লাইফ গার্ড । এছাড়াও বেসরকারী মোবাইল অপারেটর রবি কোম্পানী সৈকতে স্থাপন করেন লাইফ গার্ড। এসব বেসরকারী উদ্যোক্তারাই লাইফ গার্ড কর্মীদের বেতন ভাতা সহ অন্যান্য খরচাদি বহন করছে।
বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, গত ২০০০ সাল থেকে চলতি ২০১৬ সালের শুক্রবার জুলাই পর্যন্ত গত ১৫ বছরে শুধু সমুদ্রে গোসল করতে নেমে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মারা গেছেন প্রতিভাবান ছাত্র, ক্লোজআপ তারকা, প্রবাসী, বিদেশী পর্যটক সহ ১৪৩ জন পর্যটক। মুস্তাফিজুর রহমান সুজন, ইয়াছির, আরাফাত ইসলাম রিংটো, নাজিম উদ্দিন তোশার, মোঃ শাকিল, মঈনুল হোসেন , দীপুদাশ , মিজানুর রহমান,বাদশা মিয়া , ক্লোজআপ তারকা আবিদ, আশিক, রিংকু সহ আরো অনেক পর্যটক রয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন, জানিয়েছেন সৈকত নিয়োজিত লাইফগার্ড কর্মীরা। ওই সময়ে স্থানীয় লোকজন সহ লাইফ গার্ড কর্মীরা সাগর থেকে বিপন্ন অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করেছে আরো সহ¯্রাধিক নারী পুরুষ ও শিশু পর্যটককে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নিয়োজিত বেসরকারী উদ্ধার কর্মী দল সাবেক ওয়াচবে সিসিলন এর ইনচার্জ ও বর্তমান রবি লাইফ গার্ড ইনচার্জ মোঃ ছৈয়দ জানান,সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানে চোরা গোপ্তা গর্ত ,গুপ্ত খালে সৃষ্টি হয় হয়েছে। এতে আটকা পড়ে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে। তিনি আরো বলেন, সাগর সৈকতে চোরা গোপ্তা গর্ত, গুপ্ত গভীর খাল চিহ্নিত করে সেখানে লাল পতাকা দিয়ে ঘিরে রাখা দরকার।
এদিকে, ১৯৯২ সালে সরকারী ভাবে উন্নত প্রযুক্তিতে সী-নেটিং স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। অপরদিকে, সমুদ্র সৈকতে অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনায় প্রাণহানি হ্রাসে রবি মোবাইল অপারেটর কোম্পানী ২০১৩ সালে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। তৎসময়ে রবি কোম্পানী ঘোষণা করেছিলেন কলাতলি সী ক্রাউন পয়েন্ট থেকে হোটেল শৈবাল পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে সী-নেটিং করা হবে। বিশেষ ধরনের নেটের মধ্যে থাকবে বেলুন সংযুক্ত। জোয়ার ভাটার সময় ভাসবে এই বিশেষ ধরনের নেট। এটি পানিতে ভাসমান হবে এবং উঠা নামা করবে। জোয়ার আসলে নেটটি উপরে উঠে আসবে আর ভাাটার সময় নিচে নেমে যাবে। কেউ ভেসে গেলে সহজে আটকা পড়বে নেটের মধ্যে। এতে সহজেই বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে।
সৈকতে রবির সী-নেটিং প্রকল্পের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজুরুল ইসলাম। তাঁর ডগইয়ারেই স্থানীয় ভাবে নেটগুলো তৈরী কথা ছিল এবং রবির বিশেষজ্ঞদল বিভিন্ন লোকজনের সাথে পরাম্পর্শ করেছিলেন। কিন্তু গত তিন বছরেও প্রকল্পটির আলোমূখ দেখেনি।
এব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সী-নেটিং হলে সমুদ্র সৈকতে প্রাণহানির ঘটনা হ্রাস পাবে। সেই সাথে সৈকতে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঝুঁকি কমবে। পর্যটকদের আনন্দের ভ্রমণ বিষাদের হবে না।
পাঠকের মতামত: